‘বেঁচে থাকার জন্যই ইয়াবা পাচার করি’ এক রোহিঙ্গার স্বীকারোক্তি টিবিটি টিবিটি নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৮ | আপডেট: ৭:৩৩:পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৮ মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে অঅশ্রয় নিয়েছে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে থেকেই এখানে ছিল আরো ৪ লাখ রোহিঙ্গা। এদিকে গত এক বছর ধরে মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে বাংলাদেশ সরকার। এই মাদকের একটি জনপ্রিয় ও প্রধান উপাদান ইয়াবা, যা আসছে মিয়ানমার থেকে।ইয়াবা এক ধরনের রঙিন ট্যাবলেট যা দেখতে অনেকটা ক্যান্ডি চকলেটের মত। মিয়ানমারে তৈরি এসব ট্যাবল্যাট থেকে সীমান্তের চোরাই পথে আসা লাখ লাখ ইয়াবা বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গরাও এই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে কক্সবাজারের মাদক ব্যবসায়ী এবং ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১ কোটির বেশি ইয়াবা উদ্ধার করেছে।স্থানীয় এক সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে আল জাজিরা। কক্সবাজার জেলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মো: সাইফুল হাসান বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এ দেশে প্রবেশের শুরুতে আমরা তাদের তল্লাশি করিনি। তাদের জন্য আমরা আমাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছিলাম। এ কারণে এ সময় দেশে কিছু মাদক ঢুকেছে।’আমি স্বচ্ছ জীবনযাপন করি নাগত বছর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ প্রায় ১৫ লাখ ইয়াবা উদ্ধার এবং এর সঙ্গে জড়িত ৬৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১৫ জন রোহিঙ্গা।তবে তাদের দলে ছিলেন না ‘ক’ (ছদ্মনাম)। আল জাজিরা প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের আসনে বসে উসখুস করছিলেন ৩৫ বছর বয়সী ব্যক্তিটি। পরে সিগারেটের মধ্যে মাদক ঢুকানোর পর তিনি আরাম পেলেন। ছোটখাট দেখতে মানুষটা বসেছিল একটি বড় চেয়ারে। ফলে তার গোটা শরীর ঢুকে গিয়েছিল চেয়ারের মধ্যে। তিনি ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। প্রতি ১ হাজার ইয়াবা বহনের জন্য তিনি পান ৫ হাজার টাকা (৬০ ডলার)। তিনি এসব বড়ি কুতুবপালং থেকে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে নিয়ে আসেন।তিনি আল জাজিরাকে বলেন,‘আমি বেঁচে থাকার জন্য ইয়াবা বহন করি। আমি বাধ্য হয়ে এই কাজটি করছি। এ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই আমার সংসার চলে।’ মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্য থেকে সপরিবারে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন ওই ব্যক্তি। পরিবার বলতে তার মা, স্ত্রী আর তিন ছেলে। তারা সঙ্গে করে খুব বেশি কাপড় চোপড় বা জিনিসপত্র আনতে পারেনি। দিনে দিনে এইসব রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখানে বসবাস করছে।তবে দু বছর আগে ওই ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অতটা সহজ ছিল না। তাকে কুতুপালং শিবিরে প্রবেশ করতে দেয়নি সেনা সদস্যরা।‘আমরা তখন বিভিন্ন লোকজনের বাড়িতে লুকিয়ে থেকেছি। পরে যখন আমাদের ক্যাম্পে থাকার অনুমতি দেয়া হল তখন তো জীবন আরো কঠিন হয়ে গেছে। সেখানে পানি আর আবাসিক সঙ্কট ছিল।’নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ক এবং তার পরিবারের সদস্যদের। তখন খবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করতে বেছে নেন ইয়াবা পাচারের কাজ। এর আগে দোকান চালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন এই ব্যক্তি। কেননা তার কাছে পর্যাপ্ত মুলধন ছিল না। ফলে এই বেআইনি কাজে যুক্ত হন। ‘আমি তাদের (ইয়াবা ব্যবসায়ী) সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর দেখলাম কীভাবে তারা ইয়াবা সংগ্রহ করে এবং কীভাবে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে।’তিনি জানান, আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, বিশেষ করে যারা ভালো বাংলা জানেন। তারা টেকনাফ অতিক্রম করে মিয়ানমার যায় এবং ইয়াবা নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। এরপর এগুলো স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করেন। তিনি বলেন,‘একসঙ্গে ১০/১২ জন পাচারকারী মিয়ানমারে প্রবেশ করে। আমরা জানি কোন কোন চেকপয়েন্টে আমাদের তল্লাশি চালানো হতে পারে।তাই আমরা আলাদা আলাদাভাবে পায়ে হেঁটে, মোটরসাইকেল বা সাইকেলে করে মিয়ানমারে প্রবেশ করি। কিন্তু আপনি যদি মাইক্রোবাস বা তিন চাকার কোনো যানে করে ঢোকার চেষ্টা করেন তবে আপনাকে অবশ্যই আটকানো হবে।’বাড়ছে ইয়াবা সেবনের প্রবণতাজাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থার মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব এশিয়ায় প্রথমবারে মত ইয়াবার প্রসার ঘটে। তখন কেবল সেনা সদস্যরাই তা সেবন করতেন। পরে এই অঞ্চলে বিশিষ করে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে এই মাদকটির বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।তবে বাংলাদেশে কতজন এই মাদক ব্যবহার করে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ২০১২ সালে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৪৬ লাখ ইয়াবা ব্যবহার করে থাকে। তবে গত ৬ বছরে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। বেসরকারি সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব নরকোটিকস কন্ট্রোল (ডিএনসি) গত মে মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশে বর্তমানে ইয়াবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এদের মধ্যে ৫০ লাখ নিয়মিত এই বড়ি সেবন করে থাকেন। দেশে মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে গত মে মাস থেকে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। এরপর থেকে এই অভিযানে ১৭ হাজারের বেশি মাদক পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব।ইয়াবা সেবন ও ব্যবসার প্রবণতা কক্সবাজারেই বেশি। এ কারণে ওই এলাকায় ২৪ ঘণ্টা অভিযানে লিপ্ত আছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ বলছে, কিছু রোহিঙ্গাও ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা কিছু এনজিও এবং কর্মীর সহায়তায় তারা এ কাজ করছে।যেভাবে পাচার হয় ইয়াবা‘ক’ জানান, তিনি গত এক বছর ধরে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি সাধারণতঃ কয়েক সপ্তাহে বা মাসে একবার ইয়াবা পাচারের কাজ করেন। ‘এই পাচার থেকে মাসে গড়ে ৮-১০ হাজার টাকা পাই।’ তবে এ দিয়ে তেমন কোনো লাভ হয় না তার।ধার দেনা শোধ, মুদি দোকানের বাকি শোধ কিংবা চিকিৎসাসেবার বাবদই চলে যায় সব টাকা।পাচারের গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বিশদ বর্ণনা দেন। মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবার পিলগুলো ক্যাম্পে তার ডেরায় বা অন্য কোনো গোপন স্থানে রেখে যান। সবমিলিয়ে সেখানে সর্বোচ্চ এক হাজারে মত বড়ি থাকে।‘কখনও কখনও আমরা আমাদের জুতার মধ্যে বা বেল্টের মধ্যে পলিথিনে মোড়ানো বড়িগুলো লুকিয়ে রাখি। তবে ১-২শ হলে হাতে করেই পরিবহন করা যায়। আমরা মোবাইলের নিচে এগুলো লুকিয়ে রাখি। তখন বাইরে থেকে লোকজন মনে করে আমরা হাতে মোবাইল নিয়ে যাচ্ছি।’রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাতের বেলায় কারফিউ বলবৎ থাকায় এগুলো কুতুপালং থেকে কক্সবাজারে সরবরাহের কাজটা মোটেই সহজ নয়। এক্ষেত্রে ‘ক’ যেটা করেন তা হলো: ‘আমি ক্যাম্প ছাড়ার পর পাহাড়ি রাস্তা বেছে নেই। কখনও মেরিন ড্রাইভের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করি না। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে কক্সবাজার যাওয়া খুব সোজা। যদিও সেখানে চেকপয়েন্ট আছে। কিন্তু আমি সহজেই তাদের চোখে ধুলো দিতে পারি।’ কক্সবাজার শহরে পৌঁছে তিনি নির্ধারিত স্থানে বিলি করেন বড়িগুলো। সাধারণতঃ বিমানবন্দরের কাছে বাহারছড়া এলাকা কিংবা মাছের বাজারে এগুলো সরবরাহ করেন।এরপর টেকনাফ থেকে বাস ধরে সোজা কুতুবপালং ফিরে আসেন। পথে কেউ কিছু জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম।‘ক’ আরো জানান, রোহিঙ্গা ক্রাম্পে ৪শ-৫শ ইয়াবা পাচারকারী রয়েছে। কিন্তু নিরপত্তার কারণে তারা কেউ কাউকে চেনেন না।‘আমাদের একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগ নেই। ঝুঁকি এড়াতেই এই ব্যবস্থা। মানে ধরা পড়ার পর কেউ যেন কারো সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে না পারে এজন্যই এই ব্যবস্থা।’কর্মকর্তা সাইফুল হাসান জানান, গত এক বছরে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে ৬শয়ের বেশি রোহিঙ্গাকে আটক করেছে আইন প্রয়োহকারী সংস্থাগুলো। তবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে এসব ধৃতদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।ছয় মাসের জেল বা জরিমানার বিনিময়ে তারা সহজেই ছাড়া পেয়ে যান। বাংলাদেশে মাদক পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যা সংশোধনের চেষ্টা করছে সরকার। তবে পুলিশ বা র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অনেক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। মাদক বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে দেশে কমপক্ষে ২১১ জন মারা গেছেন।গ্রেপ্তার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আতঙ্কে আছেন ‘ক’। তিনি বলেন,‘আমি এসব বন্দুকযুদ্ধের কথা শুনেছি। অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এ নিয়ে আমরা সবাই আতঙ্কে আছি। কিন্তু আমি কি করবো? আমার টাকা থাকলে আমি এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হতাম না।’গত নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকার। যদিও এ নিয়ে তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না ‘ক’। তবে দেশে ফেরার ইচ্ছা আছে তার।তিনি বলেন, ‘যদি সত্যি সত্যিই এমন সুযোগ আসে তবে আমি দেশে ফিরে যাব। এখানকার এই নিয়ন্ত্রিত জীবন ভালো লাগছে না। দেশে ফিরে নিজের জমিতে চাষবাস করবো, ফসল ফলাবো। এখানে তো আমরা চাষাবাদ করতে পারি না। এমনকি একটা মুরগী পর্যন্ত পালতে পারিনা।’ আরও পড়ুন আইনমন্ত্রীর ‘সান্নিধ্য পেতে’ দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, আহত ১০ কুমিল্লায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ নিহত ৩