রাজবাড়ীতে বেড়েছে সূর্যমুখী চাষ

এম, মনিরুজ্জামান, রাজবাড়ী প্রতিনিধি: সূর্যমুখীর হাসিতে হাসছে রাজবাড়ীর চাষিরা। জেলার সর্বত্র এখন সূর্যমুখী ফুলের ক্ষেতে চোখ জুড়ানো ফুল শোভা পাচ্ছে।বাণিজ্যিকভাবে এখন রাজবাড়ী জেলায় সূর্যমুখি ফুলের আবাদ ব্যপক বেড়েছে।
বিশেষ করে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলায় মাঠের পর মাঠ শোভা পাচ্ছে চোখ জুড়ানো সূর্যমুখী ফুল। আর সে হাসিতে যেন কৃষকের মুখেও ফুটেছে স্বস্তির হাসি। ভোজ্য তেলের ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে কম খরচে ও কম সময়ে অধিক লাভ হওয়ায় দিন দিন সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী হচ্ছে এ জেলার কৃষকরা।
দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠে যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ গাছের ঠান্ডির মাথায় একটি করে হলুদ ফুলের সমারোহ। সবুজ পাতার গাছের মাথায় সূর্যমুখীর হলুদ ফুলগুলো বাতাসে দুলছে। আর ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৌমাছি আর প্রজাপতি। সেই দৃষ্টিকাড়া সৌর্ন্দর্য দেখতে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ছবি তুলতে ভিড় করছে সব বয়সী মানুষ। সরকারি কর্মকর্তারাও পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটির দিনে ছুটে যাচ্ছেন সেখানে।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলায় ৮০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছিল, আর চলতি বছর ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে।
বসন্ত এসেছে, র্জীণ প্রকৃতি তার নব রূপের পসরা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। হলুদের বর্ণচ্ছটায় সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানব মন ও সবুজ আর হলদে আভায় নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে। আর সেজন্যই বসন্তে ফসলের ক্ষেতের এমন দৃশ্য টানছে সৌন্দর্য পিপাসুদেরও।
প্রকৃতিতে অসাধারণ এক রূপবান উদ্ভিদ ‘সূর্যমুখী’। পাগল করা সুন্দর তার ফুল। ফুল ও প্রকৃতিপ্রেমী যে কেউ এ ফুলের নান্দনিক হলদে আভায় মুগ্ধ না হয়ে পারে না। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিশাল আকারের হলুদ গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে মাঠে মাঠে। কাছে গেলে চোখে পড়ে হাজার হাজার সূর্যমুখী ফুল। সূর্যমুখী হাসে, আর তার হাসিতে প্রকৃতি অপরূপ রূপে সাজে। ফুলগুলো বাতাসে দোল খেয়ে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সৌন্দর্য উপভোগ করার। হলুদ রঙের হাজারো ফুল মুখ করে আছে সূর্যের দিকে। এমন দৃশ্য রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার গ্রামের বিভিন্ন মাঠে মাঠে সূর্যমুখী ক্ষেতে।
ধর্মশী গ্রামের মতো সূর্যমুখী ফুলের এত বড় আকারের বাগান আগে রাজবাড়ী জেলার আর কোথায় দেখা যায়নি।
সুলতানপুর, বসন্তপুর, ছোটভাকলা ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠে একশ’ হেক্টরেরও বেশি জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। সূর্যমুখীর হলুদ আভায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। তাই দিনভর সূর্যমুখী বাগানে ভিড় করছে হাজারো মানুষ।
এ যেন সূর্যমুখী ফুলের রাজ্য। যতদূর চোখ যায়; ততদূর হলুদ রঙের ঝলকানি দেখা যায়। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সবুজের মধ্যে হলুদের সমাহার। সূর্যমুখী যেন সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। সূর্যমুখী ফুল শুধু দেখতে রূপময় নয়, গুণেও অনন্য। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সূর্যমুখী মাঠগুলো। বর্তমানে প্রতিদিন সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক দর্শনার্থী ভিড় করছেন রাস্তার পাশের ফুলের মাঠে। বসন্ত হাওয়া বইছে চারপাশে। সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সকাল বেলা পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকলেও বেলা বাড়া এবং সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যমুখীর মুখও ঘুরতে থাকে। একদিকে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার দৃশ্য, অন্যদিকে সূর্যমুখী ফুল তাকিয়ে থাকার দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। মৌমাছিরা শেষ বিকালে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সূর্যমুখী ফুল থেকে। তা ছাড়া প্রতিদিন দেখা যায় প্রজাপতির মেলা। প্রাকৃতিক এ অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলার ১০০ হেক্টর জমিতে কৃষকরা উচ্চফলনশীল জাতের সূর্যমুখী চাষ করছেন। এ ফসলের তদারকি করছেন কৃষি কর্মকর্তা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় থেকে বীজ ও সারসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হচ্ছে। চাহিদা ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা সূর্যমুখী চাষের দিকে ঝুঁকছেন। আরো বেশি জমিকে সূর্যমুখী চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যে কৃষকদের বাড়তি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
সদর উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের সূর্যমুখী চাষিরা জানান, এ বছরও এ ইউনিয়নের প্রত্যেকই এক/ দেড় একর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে।
ছোটভাকলা ইউনিয়নের অম্বলপুর গ্রামের চাষি সুলতান সরর্দার, জাফর, আলম সরর্দার, মোতাহার চৌকিদার ও নজরুল মৃধা বলেন, গত বছর আমরা ১০ একর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করে ফলন ভালো পেয়েছি বলে এ বছর আমি একাই প্রায় তিন একর জমিতে সূর্যমুখী লাগিয়েছি। তবে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ভালো ফলন হয়েছে। তেল বীজ সরিষার থেকে ফলন ও দাম বেশি এবং পোকা মাকড় না ধরায় কৃষকরা সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকচ্ছেন।
এ ইউনিয়নের অম্বলপুর গ্রামের সূর্যমুখীক্ষেতে ঘুরে দেখতে আসা নুপুর রানী, সরমিলা, শুকা, লামিয়া, মিজানুর, হারুন ও মারুফা বলেন, সূর্যমুখীর ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে ক্ষেত। সে জন্য আমরা গ্রামের লোকজন মিলে দেখতে ও স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলতে এসেছি। এসে অনেক ভালো লেগেছে।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো, জনি খান জানান, এ বছর উপজেলায় গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে আর ফলনও অনেক ভালো হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দ্বিগুণ ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি জানান, এক মন সরিষার দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা।আর সেখানে একমন সূর্যমুখির বীজের দাম সাড়ে চার/পাঁচ হাজার টাকা। সরিষা বৃষ্টিতে নস্ট হয়,আর সুর্যমুখি বৃষ্টিতে ভাল হয়্
জেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, সূর্যমুখী তেলে আছে মানবদেহের জন্য উপকারী ওমেগা ৯ ও ওমেগা ৬ ও ফলিক অ্যাসিড। আরও আছে শতকরা ১০০ ভাগ উপকারী ফ্যাট কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও পানি। এই তেল সম্পূর্ণ ক্ষতিকর কোলেস্টেরলমুক্ত। ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে মিনারেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানও এতে পাওয়া যায়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখীর তেল নিরাপদ।
তিনি বলেন, দেশে প্রতি বছর ২৮ হাজার কোটি টাকার সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। তেলের আমদানি কমাতে সরকার সূর্যমুখি চাষ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। সূর্যমুখীর গাছ জ্বালানীর ও পাতা জৈব সারের কাজেও ব্যবহার হয়। কৃষকদের আগ্রহ বাড়ায় আগামীতে সূর্যমুখীর চাষ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।