আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছাড়তে বাধ্য হবে: মার্কিন রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়া মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ডেটা সুরক্ষা আইন, কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি, ১৯১টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ব্লক করার সরকারি ঘোষণা এসব উদ্বেগজনক। এসব কারণে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। প্রায় ২ হাজারেও বেশি স্টার্টআপকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে।
‘বাংলাদেশে অনলাইন স্বাধীনতা ও ব্যবসায় বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস রোববার এমন মন্তব্য করেন।
ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধি টুওমো পওতানেন, টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং ওরাকল বাংলাদেশের রুবাবা দৌলা অংশ নেন। আলোচনা অনুষ্ঠানটি ঢাকার ইএমকে সেন্টারে রোববার দুপুরে অনুষ্ঠিত হয়।
অনলাইন উন্মুক্ত ও স্বাধীন হতে হবে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, তা না হলে বাংলাদেশের অনলাইন ব্যবসা ও সেবার ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। প্রায় দুই হাজারেরও বেশি স্টার্টআপকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে এবং প্রতিদিন যে কোটি কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারী তাদের সেবা নিচ্ছেন তারা আর এই সেবাগুলো পাবেন না।তিনি ডেটা সুরক্ষা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, অর্থনৈতিক সংযোগ এবং ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার সুপারিশ করেন এবং এ ব্যাপারে অংশীজনদের পরামর্শ ও মতামত নেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়া দেখে মুগ্ধ হয়েছেন জানিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এই শতকে ডিজিটাল বিশ্বে বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে চায় এটা স্পষ্ট। অনলাইন বিশ্বে প্রচুর সুযোগের পাশাপাশি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশ্বের সব জায়গায়ই সরকারকে অবশ্যই অনলাইন ও এর সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যবহারকারীর ডেটাকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পরিচালনা করার পাশাপাশি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করায় সচেষ্ট থাকতে হবে। কারণ, সমালোচনা গ্রহণ করার সক্ষমতা এবং অপ্রীতিকর বক্তব্য হলেও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা শক্তিশালী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।’
তিনি বলেন, ‘অনলাইন বিশ্ব আমাদের প্রচুর সুযোগের পাশাপাশি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও করেছে। বিশ্বের সব জায়গায়ই সরকারকে অবশ্যই অনলাইন ও এর সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যবহারকারীর ডেটাকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পরিচালনা করার পাশাপাশি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করায় সচেষ্ট থাকতে হবে। এ ধরনের শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত জটিল একটা বিষয়। কারণ, এটি আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষা বজায় রাখতে বাধ্য করে।’
পিটার হাস আরও বলেন, ‘আসুন, আমরা প্রথমেই অর্থনীতির বিষয় নিয়ে কথা বলি। এই শতকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত না করে বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষেই সফল হওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে আমাদের মিশনের কাজের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে একটি টেকসই ও যৌথভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া–এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তোলা, যা বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত। আমরা আমাদের লক্ষ্যকে বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছি। একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বৃহত্তর পরিসরে অর্থনৈতিক সংযোগ গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে নেতৃত্বের আসনে স্থান করে দেবে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আরও সংযুক্ত করতে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে বৈশ্বিক ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে আগ্রহ বোধ করেন এবং তারা একটি আমন্ত্রণমূলক পরিবেশ খুঁজে পান।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা ও এখানে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির ইচ্ছার কথা জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের বাজার খুবই আকর্ষণীয়। আর এ কারণেই, আমরা সম্প্রতি দূতাবাসে একটি ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিস অফিস চালু করেছি। তবে একই সময়ে আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই আশঙ্কার কথা শুনতে পাই যে, প্রস্তাবিত নতুন আইন ও প্রবিধানগুলো তাদের জন্য এখানে ব্যবসা করা আরও কঠিন করে তুলবে। এ বিষয়ে আমি একটু খোলামেলাভাবেই বলি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দিক থেকে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওভার-দ্য-টপ প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রণীত প্রবিধানগুলোর পাশাপাশি খসড়া ডেটা সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, আমরা যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্বকে মূল্য দিই, তাই আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা সরকারের কাছে সরাসরি তুলে ধরেছি। আমি আমাদের কিছু উদ্বেগের কথা বলার আগে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই: আমরা বাংলাদেশের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টিকে শ্রদ্ধা করি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিক ঘোষণার বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে ১৯১টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ব্লক করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সমালোচনা গ্রহণ করার সক্ষমতা এবং অপ্রীতিকর বক্তব্য হলেও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা শক্তিশালী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস নাগরিক সমাজের অনেক সংস্থা এবং সাংবাদিকদের কাছ থেকে এ আইন বিষয়ে শুনেছে। তাদের ভয় হলো, এ নিয়ম ও আইন মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতাকে সীমিত করবে। ডেটা সুরক্ষা আইনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা উদ্বিগ্ন যে, ডেটা সুরক্ষা আইনের সবশেষ খসড়ায় একটি স্বাধীন ডেটা তদারকি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা রাখা হয়নি এবং এ আইনে ফৌজদারি শাস্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ তাদের স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে, কিন্তু আমরা বাংলাদেশসহ সব দেশকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই। অনলাইন বক্তৃতা এবং ডেটা সুরক্ষা করা সহজ কাজ নয়। এটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। আর সেই কারণেই আমরা এ আলোচনা করছি।’