কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ঢাকার উপকণ্ঠ ও আশপাশের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা এতই বেপরোয়া যে তুচ্ছ ঘটনায় হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব জেলার বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা।
ঢাকার আশপাশে দৌরাত্ম্য বেড়েছে, ঘটছে হত্যাকাণ্ডঢাকার চারপাশের এলাকাগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উঠতি বয়সী ছেলেরা সহজে কিশোর গ্যাংয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি এখন ভয়ংকর ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিরোধ ছাড়া এই সমস্যা রোধ করা অসম্ভব। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও একই কথা বলছে। তারা এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে তত্পর বলে জানিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় উঠতি বয়সের কিশোররা সহিংসতাসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। তারা ইভ টিজিং, বখাটেপনা, মাদক সেবন, তুচ্ছ ঘটনায় হামলা, এলাকায় প্রভাব বিস্তারসহ হত্যাকাণ্ডেও অংশ নিচ্ছে। এমনকি ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে তাদের রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচিতেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ভুক্তভোগী ভয়ে মুখ খোলে না বা আইনের আশ্রয় নেয় না।
গাজীপুরে মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে অন্তত সাতটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তদন্তে কিশোর গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গাছা থানাধীন কুনিয়া পাছর এলাকার নূর নবীর ছেলে হোসেন আলীকে (২০) বাসা ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
অনুসন্ধান বলছে, শহরের ছায়াবীথি, জোড়পুকুর, রথখোলা, বিলাশপুর, বোর্ডবাজার, বাসন, কোনাবাড়ী, গাজীপুরা, এরশাদনগর, টঙ্গীজুড়ে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক দল।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে টঙ্গীর ১৫টি ওয়ার্ডে ১৯টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও রাহাজানি এখন প্রধান সমস্যা। টঙ্গীর দুই থানার মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের সদর দপ্তর বলে পরিচিত এরশাদনগর। এখান থেকে পুরো টঙ্গী নিয়ন্ত্রণ করা হয়। টঙ্গীজুড়ে ওদের ১২ থেকে ১৫টি গ্রুপ সক্রিয়।
বনমালা রেলগেট, জালাল মার্কেট, দত্তপাড়া, মধুমিতা, মরকুন, হিমারদিঘী, মাছিমপুর, বউবাজার, নদীবন্দর, পাগাড়, দেওড়া, সাতাইশ, হোসেন মার্কেট, মিলগেটসহ বিভিন্ন বস্তিতে এদের বিচরণ। টঙ্গী এলাকায় অনেক শিশু-কিশোর এখন পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী।
তবে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ দক্ষিণ) মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানের মতে, টঙ্গীতে কোনো কিশোর গ্যাং নেই। যেকোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।
নরসিংদীর শিবপুরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় মামলা হলেও জামিনে বেরিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে এসব কিশোর। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, অভিভাবকদের অবহেলায় বিপথে যাচ্ছে কিশোররা। কিশোর গ্যাং পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য মতে, কিশোর গ্যাং জেলার সবচেয়ে বেশি শিবপুরে। শিবপুর বাজার এলাকার সুমন গ্রুপ, উত্তর ধানুয়ার আলী গ্রুপ, বানিয়াদী এলাকার শওকত আলী গ্রুপ, শিবপুরের সাদ্দাম গ্রুপ এখন সক্রিয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন অপরাধ করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানাদিতেও ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের।
সর্বশেষ গত ১৬ মার্চ শিবপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় ফিরোজ মিয়া (৫৫) নামের এক মোটর মেকানিক প্রাণ হারিয়েছেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শিবপুর পৌরসভার সৈয়দেরগাঁও এলাকায় হামিদ মুন্সী (৪২) নামের একজনকে কুপিয়ে আহত করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কাজী নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘নরসিংদীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তত্পরতা আরেকটু বাড়ালে কিশোর গ্যাংসহ অনেক অপরাধ দমন করা সম্ভব।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নরসিংদীতে কিশোর গ্যাংয়ের নামে কেউ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।’
নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যায়ের দৌরাত্ম্যে তটস্থ সাধারণ মানুষ। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা খুনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফতুল্লার কুতুবপুরে কেবল ব্যবসায়ী আনোয়ারের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে কিশোর গ্যাং লিডার মুজাহিদ বাহিনী। চাঁদা না দিলে গত ১৪ মার্চ ওই ব্যবসায়ীর ডিস ও ইন্টারনেট সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়।
গত ১০ মার্চ ফতুল্লার শাহজাহান রোলিং মিল এলাকার সন্ত্রাসী পেশাদার ছিনতাইকারী দুর্জয় বাহিনীর প্রধান দুর্জয়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর এলাকা থেকে কিশোর গ্যাং আমির গ্রুপের প্রধান আমিরসহ ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
ঢাকার অদূরে সাভারে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছেই। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অস্ত্র নিয়ে হামলা, হত্যাসহ কিশোর গ্যাংয়ের নানা কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন সাভারবাসী। ওদের হামলায় কাঠমিস্ত্রি সোহেল মোল্লা খুন হওয়ার সপ্তাহ না ঘুরতেই ফের মৃত্যুর মুখে দুই স্কুলছাত্র। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পৌর এলাকার আড়াপাড়া, জালেশ্বর, বিনোদবাইদে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি।
সর্বশেষ গত রবিবার কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হয় নবম শ্রেণির দুই ছাত্র জিসান প্রামাণিক ও সিয়াম। বর্তমানে তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তুচ্ছ ঘটনা দুর্ধর্ষ হামলায় রূপ নেয়, যা খুনখারাবির পর্যায়ে পৌঁছায়। এসব কিশোরের বেশির ভাগই মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত।
ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি প্রতিরোধে সামাজিকভাবেও সবাইকে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পারিবারিক অবস্থান ও সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে।