রপ্তানিতে বড় ধাক্কার শঙ্কা
তৈরি পোশাক খাতের ৫ পণ্যে প্রণোদনা তুলে দেওয়ায় উদ্যোক্তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। এ খাতে শুরু হয়েছে নতুন সংকট। দিশাহারা হয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। এই প্রণোদনা বন্ধের ফলে রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কার আশঙ্কা করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বর্তমানে পোশাক খাত নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ^বাজারে পোশাকের চাহিদা কমছে। ডলার সংকটের কারণে সরঞ্জামাদি আমদানি করা যাচ্ছে না। নতুন করে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা কাটছেই না। এমন পরিস্থিতিতে প্রণোদনা তুলে নেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
জানা গেছে, টি-শার্ট, সোয়েটার, নিটেড শার্ট, পুরুষের আন্ডার গার্মেন্টস এবং ওভেন ট্রাউজার ও জ্যাকেট রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া থেকে সরে এসেছে সরকার। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে।
উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি প্রণোদনা একবারে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেই বিবেচনায় অল্প অল্প করে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে, দেশটি কোনো রপ্তানি প্রণোদনা দিতে পারে না।
জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা তুলে নেওয়া সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। এটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, অনেক বছর ধরেই তো প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এখন তারা নিজেরাই সক্ষম হয়ে উঠবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে হলে প্রণোদনা তুলে দিতেই হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই বলে মনে করেন তিনি।
তবে বিজিএমইএ বলছে, পোশাক খাতে যে পাঁচটি পণ্যের প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হয়েছে, দেশের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা এগুলোই উৎপাদন করে। ফলে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি বেশিরভাগ পোশাক কারখানা কোনো প্রণোদনাই পাবে না। দেশের মোট পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির বলেও জানিয়েছে বিজিএমইএ।
সার্কুলারে তিনটি বৃহৎ অপ্রচলিত বাজার অর্থাৎ জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানির ক্ষেত্রেও রপ্তানি প্রণোদনাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিজিএমইএ জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই তিনটি বাজারে পোশাক রপ্তানি ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে যখন প্রধান দুটি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৫.৬৯ শতাংশ ও ১৭.০৫ শতাংশ, তখন প্রণোদনা থেকে বাদ পড়া তিনটি নতুনবাজারে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৩.৫৬ শতাংশ। এই বাজারগুলো বাদ দেওয়ার ফলে সেখানে রপ্তানি বিপর্যস্ত হবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে প্রণোদনা তুলে দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। ছয় মাস আগে ক্রয়াদেশ নেওয়া হয়। অর্ডার নেওয়া হয়েছিল প্রণোদনার ওপর ভিত্তি করে।
এখন প্রণোদনা তুলে নিলে অর্ডার মার খাবে। নতুন করে ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে হবে। ক্রেতাদের সঙ্গে যত দর কষাকষি করা হোক না কেন, তারা এক পয়সাও বাড়ায় না। নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে পুরো পোশাক খাত।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। প্রণোদনা তুলে নিলে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প ধ্বংসের দিকে যাবে। তিনি বলেন, এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন অথচ খাতসংশ্লিষ্টরা কেউ জানে না। এটি ঠিক না।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের খাত হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের পোশাক রপ্তানি ৪৭.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পের বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন হারে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছেÑ শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে ৩ শতাংশ, ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য অতিরিক্ত ১ শতাংশ, নিট, ওভেন ও সোয়েটার খাতের সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অতিরিক্ত ৪ শতাংশ, নতুন পণ্য বা বাজার সম্প্রসারণ সহায়তা হিসেবে ৩ শতাংশ এবং তৈরি পোশাক খাতে শূন্য.৫০ শতাংশ হারে বিশেষ নগদ সহায়তা। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতে সব বাজারে সব পণ্যের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ১ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১.২৪ শতাংশ কমেছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বৃহত্তম রপ্তানি বাজার জার্মানিতে এ সময়ে রপ্তানি ২০২২-২৩ জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় ১৭.০৫ শতাংশ কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানির বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধি আমেরিকায় ৫.৬৯ শতাংশ ও কানাডায় ৪.১৬ শতাংশ কমেছে।
বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বর্তমান সময়ে রপ্তানি খাতে সবচেয়ে বেশি টানাপড়েন চলছে। রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও মুনাফা সেই হিসাবে বাড়ছে না। তিনি বলেন, মন্দার কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব কিছুর উৎপাদন মূল্য বেড়ে গেছে।
কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি মূল্য পাওয়া যায় না। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে সব ধরনের জ্বালানির দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। এমন অবস্থায় প্রণোদনাটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো হচ্ছে। তিনি শিল্প ও দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, যখন সম্ভাবনার দোয়ার খুলছে, তখন আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই, কথাবর্তা না বলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে সে অনুযায়ী আমরা অর্ডারগুলো নিয়েছি।
তিনি বলেন, এক কথায়+ এই প্রণোদনা কর্তন কার্যকর হলে দেশের এই শিল্পে একটি বিপর্যয় নেমে আসবে, অর্থনীতিতে একটি ধস নেমে আসবে। চীন ভারসতসহ বিভিন্ন দেশ প্রণোদনা দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, এই শিল্পকে রক্ষা করতে হলে, অবশ্যই আমাদের জন্য এই সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, সেটি যে নামেই রাখুক।