২৬৪ জন বিজিপির আশ্রয় গ্রহণ, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত
জসিম সিদ্দিকী, কক্সবাজার প্রতিনিধি: মায়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), মায়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার ২৬৪ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজিবি তাদেরকে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকালে বিজিবি’র জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, তারা সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নিরস্ত্র করে হেফাজতে নিয়েছে বিজিবি।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন জানান, সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবিসহ আইনশৃংখলা বাহিনী।
এদিকে বান্দরবানের তুমব্রু, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা ও চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন অনুপ্রবেশ চেষ্টার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে সীমান্তের দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি ঘটেছে। তুমব্রু সীমান্তে ঘেষা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি’র রাইট ক্যাম্প দখলে নিয়ে পতাকা উড়ছে। কিন্তু সকাল থেকে এখনো থেমে থেমে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। যার কারণে সীমান্তের বসবাসরত স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছাড়ছেন। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন পয়েন্টে চেক পোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করেছেন।
এদিকে সীমান্তের উত্তেজনার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিবেচনায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তে থাকা পাঁচটি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এদিকে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারে অভ্যন্তরে সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সংগঠন আরকান আর্মির তুমুল লড়াই চলছে। এ সময় মিয়ানমারের ছোড়া গুলিতে আরও এক বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হন। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তুমব্রু সীমান্তে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ ওই ব্যক্তি পেশায় কৃষক বলে জানা গেছে।
লাগাতার গোলাগুলি, মর্টারশেল নিক্ষেপ ও রকেট লঞ্চার বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রুর বিস্তীর্ণ এলাকা। গুলির অংশ ও রকেট লঞ্চারের ভগ্নাংশ উড়ে এসে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকায় বসতঘরের ওপর। এ ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। অনেকেই আতঙ্ক, উৎকণ্ঠায় ঘরে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। ভয়ে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেও পারছেন না অভিভাবকরা।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য ফাতেমা বেগম গণমাধ্যমে বলেন, সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। স্থানীয়রা ভয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক পরিবার সারা রাত না ঘুমিয়ে বসে ছিল।
এর আগে সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুমে সীমান্তের মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে এসে পড়েছে। সে ছোড়া মর্টার শেল ঘুমধুমে ৪নম্বর ওয়ার্ডের জলপাইতলী এলাকায় ঘরের ভিতর ঢুকে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় ঘটনাস্থলে বাংলাদেশে নাগরিক হোসনেয়ারা (৪৫), ক্যাম্প ৯ নম্বর রোহিঙ্গা নাগরিক নবী হোসেন (৫৫) নিহত হন।
একই ঘটনায় আহত হয়েছে সাত বছর বয়সী নুসরাত মনি নামে এক শিশু। একইভাবে গত রোববার মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে এপারে বাংলাদেশে প্রদীর চন্দ্র ধরসহ দুই ব্যক্তি আহত হয়েছে।
এ ঘটনার পর সীমান্তবর্তী এলাকার জুড়ে পুলিশ, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বিজিবি নিরাপত্তা জোরদার করেছে। তাই সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষদের সর্তকভাবে থাকার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ উপ-অধিনায়ক আবু সালাম চৌধুরী বলেন, বিগত কয়েকদিন ধরে সীমান্তবর্তী এলাকার উত্তেজনা শুরু হয়েছে সেটি এখনও চলমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব ও পুলিশ যে যার ক্ষেত্র থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আর সীমান্তে ঘেঁষে যেসব পরিবার আছে তারা আতঙ্কে ঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থানে আশ্রয় নিয়েছে এবং সবাইকে ঝুকিপূর্ণভাবে না থেকে নিরাপদে থাকার অনুরোধ জানান। তিনি আরও জানান, পাশপাশি সীমান্তের জোরদার করার জন্য, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো আরও জোড়দার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মঙ্গলবার দুপুরে সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে কক্সবাজার-৩৪ বিজিবির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, গেল সোমবার দুপুরে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে দু’জন নিহত হয়েছে, সেটি খুবই দুঃখের বিষয়। এ বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ডিপারটেশন ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। সেইসাথে বাংলাদেশে কোনও রোহিঙ্গা বা বিছিন্নতাবাদী দল যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেদিকে বর্ডার গার্ড বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে।
এদিকে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্তের এক লাখের বেশি মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মিয়ানমারে যুদ্ধের জেরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনা এবং আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, ইতোমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট উপজেলার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
বান্দরবন জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন ও টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সীমান্তের ওপারে মঙ্গলবারও গোলাগুলি চলছে।
দুই জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত সংলগ্ন ওইসব এলাকায় এক লাখের বেশি বাসিন্দা এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আপাতত নিরাপদ দূরত্বে স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে তাদের রাখা হবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান বলেন, ইতোমধ্যে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। প্রাথমিক অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দাদের নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কাজ করেছেন।