আনিসুলকে ঠেকাতে একাট্টা আ.লীগ
আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নিয়ে চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এম আবদুল ওয়াহাব। এরপর গত চার যুগে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেননি।
সুযোগ থাকলেও জোট-মহাজোটের হিসাবে তা কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। তবে টানা তিনবার সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে এবার ঘরের মাঝি দেখতে চান। এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ তারা।
এদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে হারিয়ে বিজয়ী হলেও এবার তাকে নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। সম্প্রতি নতুন জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা সেই আলোচনার পালে হাওয়া লাগিয়েছে।
কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগ এবারও হয়তো দলীয় প্রার্থী না দিয়ে জোটের শরিক দুই প্রার্থীর জন্য আসনটি উন্মুক্ত রাখতে পারে। এক্ষেত্রে নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা, জনসম্পৃক্ততা, উন্নয়নের হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি নির্বাচনে বিজয়ী হতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে।
অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, হাটজারীতে দল টিকিয়ে রাখতে জীবনভর লড়াই সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের মনে ক্ষোভ রয়েছে। চট্টগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসনটি উদ্ধার না হলে হাটহাজারীতে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। বারবার জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে করতে কর্মীরাও ক্লান্ত। দলের প্রার্থী নৌকা প্রতীক পেলে উজ্জীবিত হবেন কর্মীরা। অন্তত আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আসনটি উদ্ধার করা উচিত।
২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে হাটহাজারী থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন পেতে পারেন তিনি। তবে এবার হাল ছাড়বেন না আওয়ামী লীগ নেতারা।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দল ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন আনিস; তার পক্ষে ভোট চাইলেও জনগণ দেবে না। এরই মধ্যে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলসহ ১৪ জন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হন তিনি। ১৯৯১ সালে বিজয়ী হন বিএনপির সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম।
একই আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হন ওয়াহিদুল আলম। ১৯৯৬ সালে নৌকার প্রার্থী ছিলেন এমএ সালাম এবং ২০০১ সালে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল।
২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমকে পরাজিত করে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে বিএনপি ভোট বর্জন করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০১৮ সালে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে হারিয়ে বিজয়ী হন।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাটহাজারী আসনে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান এবং যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও জোটগতভাবে নির্বাচনের কারণে মহাজোট প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন অতীতে।
আগামীতেও এ সম্ভাবনা রয়েছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে নেতাকর্মীরা মহাজোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে রাখার অভিযোগ আছে আনিসুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, জোটের প্রার্থী হিসেবে ২০০৮ সালে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পক্ষে নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হাটহাজারীতে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ হওয়ার কথা, তা বাস্তবায়নে এমপি ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সাথে সমন্বয় না করায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। তাই এবার দলীয় প্রার্থী প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আনিস। এরপরই ইনডেমনিটি আইন প্রণয়নে জিয়াউর রহমানকে সহায়তা করেন।
পরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পুরো সময় ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালে নির্বাচন করেননি। আওয়ামী লীগের জ্যৈষ্ঠ নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, সে বছর ভোট দিতেও এলাকায় আসেননি।
১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে এলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ লাঙল ও নৌকা প্রতীকে আলহাজ নাজিম উদ্দিন নির্বাচনে অংশ নেন। ধানের শীষের প্রার্থী ওয়াহিদুল আলম বিজয়ী হয়েছিলেন। সে বছর জামানত হারিয়েছিলেন জাপার প্রার্থী। ১৯৯৬ সালে নৌকার প্রার্থী ছিলেন এমএ সালাম ও জাপার ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। জয়ী হয়েছিল ধানের শীষের প্রার্থী।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থীর কাছে। সে বছর নির্বাচনে আসেননি জাপার প্রার্থী। ২০০৬ সালে মহাজোট গঠনের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে হাটহাজারী থেকে এমএ সালামকে দলীয় প্রার্থী দিলে প্রচারণাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু জোটের প্রার্থী হিসেবে আনিসুল ইসলামকে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়।
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালাম বলেন, জিয়াউর রহমানের পর এরশাদের পুরো আমল ক্ষমতায় ছিলেন। মহাজোটের প্রার্থী হয়ে তিনবার নির্বাচিত হলেন।
৪৮ বছর ধরে দলের প্রার্থী নেই হাটহাজারীতে; দল টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। আমাদের সময় প্রায় ফুরিয়ে গেছে; এবার অন্তত উদ্ধার করে দিতে চাই। অন্যথায় হাটাহাজারীতে দলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, মহাজোট থেকে বের হতে পারব কিনা জানি না; তবে দলের জন্য জীবনভর লড়াই-সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের মনে ক্ষোভ আছে। নৌকার প্রার্থী দিলে হয়তো তারা উজ্জীবিত হবে নতুন উদ্দীপনা আসবে।
গতকাল সকাল থেকে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হয়, এতেও সাড়া মিলেনি। তার ব্যক্তিগত সহকারী সৈয়দ মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, উনি ঢাকায় আছেন। বিভিন্ন মিটিং নিয়ে ব্যস্ত।