রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ উত্তরাঞ্চলে ফ্লাশ লাইট পদ্ধতি ব্যবহার করে বড় হচ্ছে ড্রাগন ফল
রাজশাহী থেকে হায়দার আলী : বছর দশেক আগেও বিদেশি ড্রাগন ফল সম্পর্কে দেশের মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। সুপারশপে হঠাৎ মিলতো ২০০-২৫০ গ্রাম ওজনের বেশ দামি ফলটি। ২০১০ সালের দিকে ব্যক্তি উদ্যোগে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে কিছু চারা এনে বাংলাদেশে এই ফলের চাষ শুরু হয়। গত ১২ বছরে দেশে ড্রাগন ফলের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪০ গুণ। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, পবা, চারঘাট, বাঘা, পুঠিয়া, চাঁপাই নবাবগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকহারে ড্রাগন ফল চাষ করা হচ্ছে।
প্রথম দিকে ফলের আকার ছোট দেখা গেলেও এখন একেকটির ওজন মাপলে দেখা যায় ৭০০-৮০০ গ্রাম হচ্ছে, সুপারশপ থেকে শুরু করে ছোট-বড় বাজার, গলির মুখের ফলের দোকান এমনকি ভ্যান, ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের কাছেও মিলছে ড্রাগন ফল। ফ্লাস লাইট পদ্ধতি ব্যবহার করে ড্রাগনচাষিরা ভাল ফল পাচ্ছে, অসময়ে ফুল বেশী হচ্ছে, ফলের সাইজও বড় হচ্ছে।
রোববার (২৬ নভেম্বর) রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন ফলের বাজারে এই ফল বিক্রি হচ্ছে ফলভেদে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি।
প্রথম শ্রেণীর ড্রাগন চাষী, গুনিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ শরিফুল ইসলামের দাবি, অসাধু ড্রাগন চাষিরা ফুলে ‘ড্রাগন টনিক’ নামের একটি রাসায়নিক স্প্রে করে। এ কারণে ফল বেশ বড় হয় এবং একপাশে লাল থাকলেও আরেক পাশে থাকে সবুজ। বড় বলে দাম বেশী পেলেও আর জৈব সার দিয়ে পরিচর্যা করা বিষমুক্ত ড্রাগন ফল তুলনামূলকভাবে ছোট হয়। বাজারে দামও পাওয়া যায় খুব কম। এ অবৈধ কারবার চলতে থাকলে এক সময় টমেটোর গোদাগাড়িতে ড্রাগন ফ্লপ হবে আজ অথবা কাল। আমরা বাগানে ফ্লাস লাইট পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাল ফুল, ফল পাচ্ছি, ফলের সাইজ বড় হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ দফতরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের সাড়ে আট মাসে দেশে ড্রাগন ফল আমদানি হয়েছে ৩২৫ টন। ২০২২ সালে আমদানি হয়েছে এক হাজার ১৩০ টন।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মাত্র ৩৮ হেক্টর জমিতে ২৭৭ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৪ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৪৩১ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৮ হেক্টর জমিতে ৮১৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২৭ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ৮০২ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৪১ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৪৬৪ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ৮ হাজার ৬৫৯ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে প্রায় কোটি কেজি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে সাধারণত বাউ ড্রাগন-১, বাউ ড্রাগন-২, বারি ড্রাগন-১, পিংক ড্রাগন, ভেলভেট ড্রাগন ও ইয়োলো ড্রাগন ফলের চাষ হয়ে থাকে। বাউ ড্রাগন-১ এর ভেতরের অংশ সাদা আর ওপরের অংশ লাল রঙের হয়। বাউ ড্রাগন-২ ও বারি ড্রাগন-১-এর বাইরে ও ভেতরে লাল। গোলাপি ড্রাগনের ভেতরে ও বাইরে গোলাপি। ভেলভেট ড্রাগনের ভেতরে ও বাইরে গাঢ় লাল হয় এবং হলুদ ড্রাগনের ভেতরে সাদা আর বাইরে হলুদ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় গোলাপি ড্রাগন ও বাউ ড্রাগন-২।
ড্রাগন ফলে প্রচুর পটাশিয়াম, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন বি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স থাকায় রোগীদের ফলের তালিকায় উঠে এসেছে এটি। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়।
২০১৭ সাল থেকে চট্টগ্রামের খুলশী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. গোলাম আজম ও এসএম কামরুল হাসান চৌধুরীর সমন্বয়ে একদল গবেষক চার বছর চেষ্টার পর শীতকালে গ্রীষ্মকালীন ফলটি ফলাতে সক্ষম হন। ফ্লাশ লাইট, বিভিন্ন পাওয়ারের এলইডি লাইট এবং ৬-১০ ঘন্টা লাইটের আলোয় চাষ করা হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি ড্রাগন ফল-১। এই পদ্ধতি উদ্যোক্তা কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কয়েকজন আগ্রহীকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। কিন্তু সে পথে এগোয়নি কেউ।
ড. এএসএম হারুনুর রশিদ আরও জানান, সাধারণত অফ সিজনে ড্রাগন ফল পাওয়া যায় না। কিছু সুপারশপে পাওয়া যায়। প্রতি কেজি এক হাজার টাকারও বেশি। আর সিজনে এর দাম থাকে ২৫০-৩০০ টাকা। এই পদ্ধতিতে চাষ করা গেলে সারা বছর বিষমুক্ত ড্রাগন ফল সহজলভ্য হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৃষিবিদ জীবন রায় এর একটি পোস্ট সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, ‘২০১১-১২ সালে বাংলাদেশের উপযোগী করে ড্রাগন চাষের বিজ্ঞানসম্মত উপায় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন আমাদের প্রফেসররা। তখনও এতো বড় ড্রাগন দেখা যায়নি। এমনকি থাইল্যান্ড কিংবা চীন থেকে যে ড্রাগন আসে, সেগুলোও এতো বড় নয়’।
‘প্রচুর পরিমাণ বিষ আছে এগুলোতে।
রাজশাহী জেলার উপ-পরিচালক মোঃ মোজদার হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষনা এক ইঞ্চি জমি ফাঁকা ( পতিত) রাখা যাবে না। এ ঘোষনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য,স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে। ড্রাগন চাষ তারই একটি অংশ, এ ড্রাগন চাষে ড্রাগন টনিক নামে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা আমার জানা নেই। এটা ক্ষতিকারক কি না সেটা দেখা হবে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এব্যপারে সর্তক থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এধরনের কাজ হলে ফল বড় হলে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, শীতকালে গ্রীষ্মকালীন ফলটি ফলাতে সক্ষম হলে ফ্লাশ লাইট, বিভিন্ন পাওয়ারের এলইডি লাইট এবং ৬-১০ ঘন্টা লাইটের আলোয় চাষ করা হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি ড্রাগন ফল-১। এই পদ্ধতি উদ্যোক্তা কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ায় বেশ কয়েকজন আগ্রহীকে কৃষক কাজটি করছেন ভাল ফলও পাচ্ছেন।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোসাঃ মরিয়ম আহম্মেদ এ প্রতিবেদককে জানান, ড্রাগনটনিক নামে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের যে নিউজ প্রকাশ হয়েছে তা গোদাগাড়ীর জন্য সঠিক নয় গোদাগাড়ীর কৃষকগণ ড্রাগনটনিক ব্যবহারের বিষয়টি জানেন না। এখানকার কৃষকদের বেশী বেশী জৈবসার ব্যবহার পরামার্শ দেয়া হচ্ছে, এসার করায় ফুল, ফল বড় হচ্ছে, বেশী বা ঘন ফুল ফল সরানোর ফলে ফলও বড় হচ্ছে। ড্রাগনচাষ বেশী হওয়ায় একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে। টমেটোর মত গোদাগাড়ীর বাজার নষ্ট করার জন্য।
গোদাগাড়ীর আর্দশ কৃষক, বঙ্গবন্ধু পদক প্রদকপ্রাপ্ত ড্রাগনচাষি মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, ড্রাগনটলিক ব্যবহারের বিষয়টি সামগ্রিক ব্যপার ড্রাগনটনিক একটি টেমিক্যাল এটা ইন্ডিয়ান প্রডাক্ট, সীমান্তদিয়ে আসলো কি করে, এটা আমাদের দেশে সীমান্ত দিয়ে আসলো কিভাবে, ব্যবহার করার বিষয়টি জানালো কে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তবে আমার ড্রাগনের বাগানে এ কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। যারা করে তাদেরকে সর্তক করতে হবে সচেতেনতা সৃষ্টি করতে হবে।