কুমিল্লার লাল মাটির পাহাড় ‘লালমাই’ এখন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
ব্যুরো চীফ, কুমিল্লা: কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর গ্রাম। এই গ্রামটির প্রায় পুরো অংশই পড়েছে পাহাড়ি এলাকা জুড়ে। গ্রামটির পাশেই কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও বরুড়ার উপজেলার সীমান্তে রয়েছে লালমাই পাহাড়ের চন্ডিমুড়া এলাকা। পাহাড়ের মাথায় চন্ডিমুড়ায় অবস্থান করছে সনাতন ধর্মাম্বলম্বীদের তীর্থ স্থান। আর এই তীর্থ স্থানের পাশেই বড় ধর্মপুর এলাকায় লালমাই পাহাড়ে ৬১ একর জায়গা জুড়ে ছিলো পরিত্যক্ত জঙ্গল। এই সম্পত্তির ৫২ একরের মালিক বন বিভাগ। জঙ্গলে পরিণত হওয়া বাকি জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। প্রায় তিন বছর আগেও দিনদুপুরেও মানুষজন এখানে যেতে ভয় পেতেন; পুরো স্থানটি ছিলো অপরাধী আর মাদক কারবারিদের অভয়ারণ্য।
তবে গত কয়েক বছরের মধ্যে পাল্টে গেছে পুরোনো দৃশ্যপট। লালমাই পাহাড়ের সেই পরিত্যক্ত জঙ্গলকে ঘিরেই এখন খুলেছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে স্থানীয় এলাকাবাসীর। বন বিভাগের ৫২ একর আর স্থানীয়দের ৯ একর সম্পত্তি ইজারা নিয়ে পতিত জমির ব্যবহার ও বেকারদের কর্মমুখী করতে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন। মূলত ওই সংগঠনের ৮১ সদস্যের মাধ্যমেই লালমাই পাহাড়ের সেই পরিত্যক্ত জঙ্গলকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চন্ডিমুড়ার ওই তীর্থ স্থানের পূর্ব পাশ ঘেঁষে পাহাড়ে একটি ইট বিছানো সড়ক প্রবেশ করেছে। সড়কটি দিয়ে একটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে ছোট-বড় পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। রোপণ করা হয়েছে হাজার হাজার বনজ ও ঔষুধি গাছ। পাহাড়ের মাথায়ও রয়েছে ইট বিছানো পথ। মানুষজন সেখানে ঘুরতে আসছেন। পাহাড়ের দুটি টিলার মধ্যখানে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম লেক। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজিও। পুরো প্রকল্প এলাকাটিতে কাজ করেই স্থানীয়রাই। এতে দূর হচ্ছে বেকারত্ব।
বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপক মো.আবুল কাশেম জানান, আগে এখানে দিনের বেলায় মানুষ আসতে ভয় পেত। গত ৫০/৬০ বছরেও এখানে কেউ যায়নি ভয়ে। তবে পুরো এলাকাটি ছিলো চোর-মাস্তান আর মাদক কারবারি-মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য। আমাদের সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার। প্রকল্প এলাকাটিতে তাঁর নিজেরও কিছু জায়গা রয়েছে। মূলত তাঁর উদ্যোগের কারণেই সেই পরিত্যক্ত জঙ্গলকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
মো.আবুল কাশেম বলেন, বন বিভাগ আমাদেরকে ১৫ বছরের জন্য উপকারভোগী হিসেবে ৫২ একর সম্পত্তি লিজ দিয়েছে। বাকি ৯ একর সম্পত্তি স্থানীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে লিজ নেওয়া হয়েছে। ৫২ একর জায়গার মধ্যে বন বিভাগ থেকে দেওয়া ৬৮ হাজার ফলজ ও বনজ গাছ লাগানো হয়েছে। পাহাড়ের দুটি টিলার মধ্যখানে তৈরি করা করা জলাশয় থেকেই বিভিন্ন ফসলের গাছে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ওই এলাকায় ৪ একর ভূমিতে জেলায় প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আনারসের চাষ হয়েছে। হানিকুইন জাতের আনারসে হাসছে পাহাড়ের বড় ধর্মপুর এলাকা। পাহাড়ের ঢালু ও মাঝের সমতল ভূমিতে আনারসের চারা বেড়ে উঠছে। সেখানে রোপণ করা হয়েছে ৭০ হাজার আনারসের চারা। পাশেই করা হয়েছে ড্রাগন ফলের বাগান। ময়মনসিংহ থেকে এনে আম্রপালি গাছ লাগানো হয়েছে ১২’শর বেশি। এছাড়া দেশ-বিদেশি আরও বিভিন্ন প্রকার ১৫০০ আম গাছ লাগানো হয়েছে। চার ফুট লাম্বা গাছে ধরেছে আমড়া; এমন গাছ আছে তিন শতাধিক। কাঁঠাল গাছ লাগানো হয়েছে ১ হাজারের বেশি। বিভিন্ন প্রজাতি লেবু গাছ লাগানো হয়েছে ৮ শতাধিক, ঔষুধী গাছ লাগানো হয়েছে এক হাজারের বেশি। রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের বাঁশঝাড়। আছে বিদেশি ত্বিন ফল ও খেজুরের গাছও। পুরো এলাকাটিতে রাতে আলোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে সোলার বাতি।
বড় ধর্মপুর এলাকাটি পড়েছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এম এম শাহারিয়ার ভূঁইয়া বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত এই এলাকাটি পরিদর্শন করছি। তাদেরকে পরামর্শ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের কারণে এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির খান বলেন, ২-৩ বছর আগেও স্থানটি ছিলো পরিত্যক্ত জঙ্গল। আর এখন সেখানে সৃষ্টি হয়ে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই উদ্যোগের কারণে এলাকায় বেকারত্ব দূর হচ্ছে। অনাবাদি জমিতে বিভিন্ন ফল ও শাক-সবজির চাষ হচ্ছে। আমার জানা মতে কুমিল্লা জেলায় প্রথমবারের মতো এখানেই বাণিজ্যিকভাবে আনারসের চাষ হয়েছে।
বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার বলেন, লালমাই পাহাড়ের বড় ধর্মপুর এলাকার পতিত জমি ব্যবহার ও বেকারদের কর্মমুখী করতে আমরা ‘বড় ধর্মপুর মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামীয় ৮১ সদস্যের একটি সংগঠন করি। সংগঠনের সদস্যদের এবং বন বিভাগ থেকে লিজ নেওয়া জমিতে পরিকল্পিতভাবে আমরা ফলজ ও বনজ বৃক্ষ রোপণ করেছি। পাহাড়ের দুটি টিলার মধ্যখানে কৃত্রিম লেক করেছি। লেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করেছি। নিচু জমিতে টমেটোসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি। আমি আশা করছি কয়েক বছরের মধ্যে লালমাই পাহাড়ের এই অংশটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। এটির পাশেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী চন্ডি মন্দির ও দুতিয়া দিঘি। আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।